বাংলাধ্বনি নিউজ ডেস্ক, ২৪ এপ্রিল ২০২৫ | গত বছরের ৫ আগস্ট পরিবর্তিত পরিস্থিতির মধ্যে দিয়ে নারায়ণগঞ্জে হেফাজতের কমিটি নিয়ে বিরোধ চলছে নেতাকর্মীদের মধ্যে। একটি পক্ষের নেতাকর্মীরা আরেকটি পক্ষকে মেনে নিতে পারছেন না। সেই সাথে এই বিরোধ এখনও মেটাতে পারেননি কেন্দ্রীয় নেতারা।
এরই মধ্যে ঢাকার জাতীয় মহাসমাবেশ সফল করার লক্ষ্যে গণজমায়েতের ঘোষণা দিয়েছেন হেফাজত। নারায়ণগঞ্জ জেলা হেফাজতের ব্যানারে আয়োজিত এই গণজমায়েতে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমীর আল্লামা আব্দুল আউয়াল। সেই সাথে বিশেষ অতিথি হিসেবে হেফাজত ইসলামের সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব এবং প্রধান আলোচক হিসেবে যুগ্ম মহাসচিব মাওলানা মুহাম্মদ মামুনুল হক উপস্থিত থাকবেন। কিন্তু এই গণজমায়েত নিয়ে নারায়ণগঞ্জ হেফাজতের নেতাকর্মীদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি হয়েছে।
প্রধান অতিথি হিসেবে হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমীর আল্লামা আব্দুল আউয়ালকে রাখা হলেও তার পুরোপুরি নির্দেশনা মানা হয়নি। তাকে যখন এই গণজমায়েতের কথা বলা হয় তখন তিনি বলেছেন আগে নারায়ণগঞ্জে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান করতে হবে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত বিরোধ না মিটিয়েই গণজমায়েতের ঘোষণা দেয়া হয়েছে। সেই সাথে তাকে প্রধান অতিথি হিসেবে রাখা হয়েছে।
এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ উলামা পরিষদের সেক্রেটারী মুফতী জাকির হোসাইন কাসেমী বলেন, কতিপয় বিতর্কিত নেতাদের কারণে হেফাজতের ইমেজ নষ্ট হচ্ছে। বিশেষ করে জুনায়েদ আল হাবিব ও মনির হোসাইন কাসেমীর মতো ব্যক্তিরা বহু বিতর্কের জন্ম দিয়েছেন। এমনকি নারায়ণগঞ্জে যারা ত্যাগী যারা হেফাজতকে প্রতিষ্ঠিত করেছে উনাদেরকে পাশ কাটিয়ে বিতর্কিত কিছু লোকদের নিয়ে পকেট কমিটি করে বড় ধরনের ঝামেলা সৃষ্টি করেছে। অতীতে কিছু মানুষ মুরুব্বীদের সাথে বেয়াদবি করেছে।
তিনি আরও বলেন, কেন্দ্রে বিচার দেয়া হয়েছে। কেন্দ্র থেকে মুরুব্বীরা এসে এটা সমাধান করার কথা। এই সমাধান ব্যতিত নারায়ণগঞ্জে হেফাজতের নামে কোনো কর্মসূচি সভা সমাবেশ করা ঠিক হবে না। এখানে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হওয়ার সম্ভাবনা আছে। আমরা কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দকে অনুরোধ করবো নারায়ণগঞ্জে ঝামেলা মিটানো ব্যতিত নারায়ণগঞ্জে হেফাজতের নামে কোনো কর্মসূচি যেন না দেন। যদি করেন তাহলে এখানে হেফাজত ক্ষতিগ্রস্ত হবে দুর্বল হবে। এখানে কোনো পোগ্রাম সফল হবে না। নারায়ণগঞ্জের জনগণ এটা মেনে নিবে না।
হেফাজত নেতাকর্মীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাকালিন সময়ে তৎকালিন মহানগর হেফাজত ইসলামের সভাপতি মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান ও তার অনুসারিরা শামীম ওসমান ও সেলিম ওসমানের সাথে ভালো সম্পর্ক বজায় রাখতেন। সেই সাথে তাদের অনুসারীদের সাথেও মাওলানা ফেরদাউসের ভালো সম্পর্ক ছিলো। বিভিন্ন সময় ওসমানদের স্বার্থ আদায়ে মাওলানা ফেরদাউস হেফাজতের নেতাকর্মীদের নিয়ে কর্মসূচি পালন করতেন।
বিভিন্ন সময় হেফাজত ইসলামের নেতাকর্মীরা গ্রেফতার হলেও ফেরদাউস থাকতো ধরা ছোঁয়ার বাইরে। মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান মহানগর হেফাজত ইসলামকে এককভাবে নিয়ন্ত্রণ করতেন। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকাবস্থায় এ নিয়ে কেউ কিছু বলতেন না। কিন্তু গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর থেকেই ফেরাদউসকে নিয়ে হেফাজত ইসলামের মধ্যে ক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছে। সেই ক্ষোভের সূত্র ধরেই এবার তাকে মহানগর হেফাজতের একক নেতৃত্বে চাননি একটি অংশ।
এরই মধ্যে গত বছরের ৬ সেপ্টেম্বর বিকেলে আলী আহাম্মদ চুনকা নগর পাঠাগার ও মিলনায়তনে নারায়ণগঞ্জ মহানগর শাখার হেফাজতে ইসলামের প্রতিনিধি সম্মেলন হওয়ার কথা ছিলো। সে লক্ষ্যে সকল প্রকার প্রস্তুতিও সম্পন্ন করা হয়েছিলো। আর এই সম্মেলনকে কেন্দ্র করে মহানগর হেফাজত ইসলামের সভাপতি মাওলানা ফেরদাউসুর রহমান একা একাই সবকিছু করে যাচ্ছিলেন। কিন্তু তার একক নিয়ন্ত্রণে বাধা হন অন্যরা।
ফলশ্রুতিতে নারায়ণগঞ্জ মহানগর শাখার হেফাজতে ইসলামের প্রতিনিধি সম্মেলন সাময়িকভাবে স্থগিত করা হয়। একই সাথে নারায়ণগঞ্জ মহানগরে ‘ওসমানদের দালাল’ খ্যাত তথা ওসমানীয় মুক্ত হেফাজত ইসলামের দাবীতে ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলেন হেফাজতে ইসলামের একটি অংশের নেতাকর্মীরা।
পরবর্তীতে ওই ৫ সেপ্টেম্বর হেফাজত ইসলামের নেতাকর্মীরা হেফাজতে ইসলামের নায়েবে আমির হিসেবে আল্লামা আব্দুল আউয়ালের সাথে সাক্ষাৎ করেন। সেই সাথে তারা মাওলানা ফেরদাউসুর রহমানের বিরুদ্ধে আব্দুল আউয়ালের কাছে অভিযোগ করেছিলেন। আব্দুল আউয়াল বিষয়গুলো দেখবেন বলে আশ্বস্ত করেছিলেন।
যার প্রেক্ষিতে গত ৬ সেপ্টেম্বর হেফাজত ইসলামের কেন্দ্রীয় নেতারা শহরের আমলাপাড়া মাদ্রাসায় রুদ্ধদার বৈঠকে বসেছিলেন। যেখানে ছিলেন হযরত মাওলানা আব্দুল আউয়াল সাহেব, হযরত মাওলানা জুনায়েদ আল হাবিব সাহেব, হযরত মাওলানা মুনির হুসাইন কাসেমী সাহেব, হযরত মাওলানা মামুনুল হক সাহেব, হযরত মাওলানা বশির উল্লাহ সাহেব, হযরত মাওলানা আব্দুল কাদের সাহেব, হযরত মাওলানা মুজিবুল ইসলাম সাহেব, হযরত মাওলানা মামুনুর রশীদ সাহেব, হযরত মাওলানা মাহমুদ হাসান সাহেব।
কিন্তু এসকল বিষয়গুলো মাওলানা ফেরদাউসুর রহমানের কাছে ভালো লাগেনি। তিনি তার বিরুদ্ধে এই তৎপরতাকে মেনে নিতে পারেননি। তাই তিনি হেফাজতের নেতাকর্মীদের নিয়ে মিছিল করেছিলেন। সেই সাথে মিছিল শেষে বাগে জান্নাত মসজিদে সমাবেশ করছেন। সেই সমাবেশ থেকে আবার হেফাজত ইসলামের নেতাকর্মীদের দেখে নেয়া কিংবা চিহ্নিত করে প্রকাশ্যে বিচার করার হুমকি দিয়েছিলেন।
একই সাথে গত বছরের ২৭ সেপ্টেম্বর নারায়ণগঞ্জে হেফাজতে ইসলামের মিছিলে দুই গ্রুপের মধ্যে হাতাহাতির ঘটনা ঘটেছে। এদিন জুমআর নামাজের পর শহরের ডিআইটি কেন্দ্রীয় রেলওয়ে জামে মসজিদের সামনে এই ঘটনা ঘটে। প্রায় মিনিট দশেক ধরে হেফাজতের নেতাকর্মীদের মধ্যে হৈ চৈ ও হাতাহাতি চলে। পরে সিনিয়ররা নেতারা বার বার অনুরোধ করলে থামে। তবে পণ্ড হয়ে যায় পূর্ব ঘোষিত বিক্ষোভ মিছিল। পরবর্তীতে অপর একটি গ্রুপ মিছিল করে শহরের প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে।
কিন্তু এসকল সমস্যার সমাধান না করেই নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর হেফাজত ইসলামের নতুন কমিটি ঘোষণা করে দেয়া হয়। নারায়ণগঞ্জ হেফাজতে ইসলামের দুইজন নায়েবে আমীর থাকলেও তাদের একজনও কমিটি ঘোষণার সময়ে তারা কেউই ছিলেন না। সেই সাথে হেফাজতের একটি অংশের নেতাকর্মীরা এই কমিটিকে মেনে নেননি। তারা প্রত্যাখানের ঘোষণা দেন।
গত ৪ অক্টোবর সন্ধ্যায় শহরের বাগে জান্নাত মসজিদের দ্বিতীয় তলায় প্রতিনিধি সম্মেলনের মধ্য দিয়ে হেফাজতে ইসলাম সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব ও ঢাকা মহানগর সভাপতি মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীব এই কমিটি ঘোষণা করেন।
নারায়ণগঞ্জ জেলা হেফজত ইসলামের কমিটিতে সভাপতি হিসেবে রয়েছেন মুফতি মনির হোসাই কাসেমী এবং সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রয়েছেন এবিএম সিরাজুল মামুন। সেই সাথে মহানগর হেফাজত ইসলামের কমিটিতে সভাপতি হিসেবে মুফতি হারুনুর রশদি ও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে রয়েছেন মাওলানা মীর আহমাদুল্লাহ।
কমিটি ঘোষণা প্রসঙ্গে মাওলানা জুনায়েদ আল হাবীব বলেছিলেন, আপাতত আমরা নারায়ণগঞ্জ জেলা ও মহানগর হেফাজতে সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের নাম ঘোষণা করেছি। পরবর্তীতে সংশ্লিষ্ট সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক মিলে মিডিয়ার মাধ্যমে কমিটির অন্যান্য সদস্যদের নাম ঘোষণা করবেন।
সেই সাথে প্রতিনিধি সম্মেলনে উপস্থিত থাকা খেলাফত মজলিসের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক বলেছিলেন, একটা গাছের মধ্যে অনেকগুলো ডাল থাকে। যখন এই ডালগুলো প্রসারিত হয় তখন একটার সাথে আরেকটা আঘাত লাগে। তেমনি একসাথে চলতে গেলে মানুষের মধ্যে মতের অমিল হয়। সবগুলো মতকে কাছাকাছি এনে সমন্বয় করে একটি সুন্দর কমিটি পুনর্গঠনের জন্যই আমরা একটু বেশি সময় নিয়েছি।
তিনি আরও বলেন, নতুন কমিটি ঘোষণার পর যারা দায়িত্বপ্রাপ্ত হবেন সকলের ব্যক্তিগত চাওয়া পাওয়ার উর্ধ্বে উঠে ইসলামের চাওয়া পাওয়াকে অগ্রাধিকার দিবেন। সকলেই কল্যানচিন্তার ভিত্তিতে আগামী দিনের কার্যক্রম পরিচালনা করবো।
এদিকে এই কমিটি ঘোষণার পর থেকেই হেফাজতের একটি অংশের মধ্যে চরম ক্ষোভ দেখা দেয়। হেফাজতের নেতাকর্মীদের দাবী ছিলো নতুন কমিটিতে আওয়ামী লীগের দোসরদের জায়গা দেয়া হবে না। কিন্তু নারায়ণগঞ্জে যারা ওসমান পরিবারের দোসর হিসেবে পরিচিত তাদেরকে জায়গা দেয়া হয়েছে। যা হেফাজতের নেতাকর্মীরা মেনে নিতে পারছেন না।
-কা/ত/মা