রাজধানীতে রাস্তা অবরোধ করে একের পর এক বিক্ষোভ কর্মসূচি ঘিরে সৃষ্ট বিশৃঙ্খলা ঠেকাতে হিমশিম খাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। সাধারণ মানুষের জীবনও হয়ে উঠেছে অতিষ্ট। তবে দাবি আদায়ের নামে এসব বিক্ষোভের অনেকই ‘উদ্দেশ্যমূলক’ বলে মনে করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। তাই সড়ক অবরোধ করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি না করতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে পুলিশের পক্ষ থেকে।
গত ৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত রাজধানীতে কতগুলো বিক্ষোভ সমাবেশ কিংবা সড়ক অবরোধের মতো ঘটনা ঘটেছে এর কোনো সঠিক পরিসংখ্যান জানা যায়নি। তবে অন্তর্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার প্রথম ছয় মাসে পুলিশকে ১৩৬টি আন্দোলন মোকাবিলা করতে হয়েছে বলে জানানো হয়েছে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের পক্ষ থেকে। গত ২৯ জানুয়ারি বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ভেরিফায়েড ফেসবুক পেজ থেকে এ তথ্য জানানো হয়।
অন্যদিকে সময়ের আলোর অনুসন্ধানে দেখা গেছে, চলতি বছরের ১১৩ দিনে (১ জানুয়ারি থেকে ২৩ এপ্রিল) রাজধানীতে ৫৪টি আন্দোলন হয়েছে বিভিন্ন ব্যানারে। গত চার মাসের ঘটনা পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিক্ষোভকারীদের মধ্যে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক ছিলেন শিক্ষার্থী ও শ্রমিক। চাকরি-সংক্রান্ত বিক্ষোভের সংখ্যাও ছিল উল্লেখযোগ্য। তবে আাগস্টের পর বিভিন্ন দাবি নিয়ে বিক্ষোভের সংখ্যাও কমছে। প্রথম ৬ মাসে গড়ে প্রতি মাসে ২২টিরও বেশি বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে। অন্যদিকে চলতি বছরে প্রতি মাসে গড়ে প্রায় ১৪টি করে বিক্ষোভ সমাবেশ হয়। আর গত ৯ মাসে প্রতি মাসে গড়ে বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে ১৮টিরও বেশি। অর্থাৎ মাসের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সময়েই রাজধানীর কোনো না কোনো রাস্তা বিক্ষোভকারীদের দখলে ছিল দিনের কর্মব্যস্ত সময়ে। প্রায় প্রতিটি ঘটনাতেই সড়ক অবরোধ করে এসব বিক্ষোভ সমাবেশ হয় এবং এ কারণে সড়কে যান চলাচল বাধাগ্রস্ত হয়েছে।
চলতি বছরের জানুয়ারিতে রাজধানীতে ২৩টি বিক্ষোভ সমাবেশ ও সড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটে। আন্দোলনকারীদের মধ্যে ছিলেন উন্নত চিকিৎসার জন্য জুলাই-আগস্টে গণঅভ্যুত্থানে আহতরা, স্বতন্ত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের দাবিতে তিতুমীর কলেজের শিক্ষার্থীরা, ৫ দফা দাবিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ৭ কলেজের শিক্ষার্থীরা, টিকা না পেয়ে সৌদি আরবসহ মধ্যপ্রাচ্যগামী প্রবাসীরা, উচ্চ শিক্ষার সুযোগসহ ৪ দফা দাবিতে মেডিকেল অ্যাসিসট্যান্ট ট্রেনিং স্কুলে (ম্যাটস) শিক্ষার্থীরা, ৩ দফা দাবিতে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা, মালয়েশিয়া যেতে না পারা শ্রমিকরা, পাঠ্যপুস্তকে আদিবাসী শব্দসংবলিত গ্রাফিতি পুনর্বহালের দাবিতে আদিবাসীরা, চাকরি পুনর্বহালের দাবিতে ৪০তম ক্যাডেট ব্যাচের এসআইরা, চাকরিচ্যুত বিডিআর পরিবারের সদস্যদের সন্তানরা, রাজধানীতে চলাচলের দাবিতে রাজধানীর পাশ্ববর্তী এলাকার সিএনজি অটোরিকশা চালকরা।
ফেব্রুয়ারি মাসে ১৩টি বিক্ষোভের ঘটনায় সড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটে। বিদেশ যাওয়ার সুযোগ, সিএনজি অটোরিকশার জরিমানার বিধান বাতিল, চাকরি পুনর্বহালসহ বিভিন্ন দাবিতে বিক্ষোভকারীদের মধ্যে ছিলেন ছাত্র, সিএনজি অটোরকশাচালক, পরিবহন শ্রমিক, প্রবাসী শ্রমিক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা।
মার্চে রমজান মাস থাকায় সড়ক অবরোধের খুব বেশি ঘটনা না ঘটলেও বিভিন্ন ইস্যুতে ৭-৮টি বিক্ষোভের ঘটনা ঘটে। মাগুরায় আট বছরে শিশু আছিয়া ধর্ষণের ঘটনাকে কেন্দ্র করে রাজধানীতে বেশ কিছু বিক্ষোভ হয় মার্চ মাসজুড়ে। প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দেওয়াকে কেন্দ্র করে গত ১১ মার্চ ‘ধর্ষণ ও নিপীড়নের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ’ প্ল্যাটফর্ম সদস্যদের সঙ্গে পুলিশের সংঘর্ষ ঘটে ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেলের সামনে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও মধ্যরাতে মিছিল করেন। রাজধানীর মোহাম্মদপুরে এক তরুণীর ধূমপান করাকে কেন্দ্র করে হট্টগোলের ঘটনায় স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টার বক্তব্যকে কেন্দ্র করে পাল্টাপাল্টি মিছিল হয় রমজান মাসে। সড়ক দুর্ঘটনায় দুই পোশাকশ্রমিক নিহতের ঘটনায় মার্চে বনানীতে সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করেন পোশাকশ্রমিকরা। বকেয়া বেতন-ভাতা ও বোনাস না দেওয়ায় রাজধানীর পার্শ্ববর্তী গাজীপুরে বেশ কিছু সড়ক অবরোধ করা হয়। গত ৫ আগস্টের পর থেকে গাজীপুরে পোশাকশ্রমিকরা ৯০ বার সড়ক অবরোধ করেন।
এপ্রিল মাসে গতকাল পর্যন্ত ৯টি বিক্ষোভ হয় রাজধানীতে। বেশ কিছু ঘটনায় বন্ধ হয়ে যায় সড়কে যান চলাচল। এর মধ্যে গত ১০, ১৫ ও ২২ এপ্রিল ঢাকা কলেজ ও সিটি কলেজের শিক্ষার্থীদের মধ্যে তুচ্ছ কারণে তিনটি সংঘর্ষ ঘটে। এতে রণক্ষেত্রে পরিণত হয় ওইসব এলাকা। ছয় দফা দাবিতে ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা সড়ক অবরোধ করায় চরম ভোগান্তিতে পড়ে নগরবাসী। ম
হানবী হজরত মুহাম্মদ (সা.)-কে নিয়ে কটূক্তি করায় গত মঙ্গলবার মহাখালীতে সড়ক অবরোধ করেন কোহিনূর কেমিক্যালের শ্রমিকরা। বকেয়া বেতনের দাবিতে নতুন বাজারে রাস্তায় ময়লা ফেলে যান ও পথচারী চলাচলে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেন ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের পরিচ্ছন্নতা কর্মীরা। ভারতের সংসদে পাস হওয়া বিতর্কিত ওয়াকফ সংশোধনী বিল বাতিল দাবি ও মুসলিম নিধন বন্ধের দাবিতে গত বুধবার গণমিছিল করেছে বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস।
এ ছাড়া চলতি মাসে রাজধানীর অনেক স্থানে আওয়ামী লীগের ঝটিকা মিছিলের প্রতিবাদে এবং দলটিকে নিষিদ্ধের দাবিতে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের ব্যানারে বিক্ষোভ মিছিল ও পথসভা হয়েছে। এসব মিছিল ও সমাবেশকে কেন্দ্র করেও সৃষ্টি হয় জনদুর্ভোগ।
এদিকে গত প্রায় ৯ মাস ধরে রাজধানীতে একের পর এক বিক্ষোভ সমাবেশ ও সড়ক অবরোধ মোকাবিলা করে সড়কে যানচলাচল স্বাভাবিক করতে হিমশিম খেতে হচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে। গত ৫ আগস্টের পর মনোবল পুনরুদ্ধারে চেষ্টারত পুলিশের পক্ষে এসব বিক্ষোভের ঘটনা মোকাবিলা করাটা বেশ কৌশলের ও কঠিন।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনী মনে করছে, বিভিন্ন দাবি আদায়ের নামে সড়ক অবরোধ করে জনদুর্ভোগ সৃষ্টির পেছনে কারও কারও দুরভিসন্ধি আছে। ইচ্ছাকৃতভাবে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি করে অন্তর্বর্তী সরকারকে বিব্রত করতে অনেকে এ ধরনের কাজ করছে বলে সন্দেহ করা হচ্ছে।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্যের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, সরকারকে বেকায়দায় ফেলতে অনেক ক্ষেত্রেই নামসর্বস্ব কিছু প্রতিষ্ঠানের ব্যানারে দাবি আদায়ের নামে রাজধানীর ব্যস্ততম সড়কগুলো অবরোধ করে ভোগান্তির সৃষ্টি করা হচ্ছে। এর পেছনে আত্মগোপনে থাকা আওয়ামী লীগের নেতাদের ইন্ধন আছে। তবে যেহেতু পুলিশ এখনও নিজেদের কার্যক্ষমতা পুরোপুরি ফিরে পায়নি তাই সুকৌশলে ‘কৃত্রিম’ বিক্ষোভগুলো মোকাবিলা করছে। পুরোপুরি শক্তি প্রয়োগ না করে ধৈর্যসহকারে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা করছে। তবে যতদিন যাবে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জনদুর্ভোগ সৃষ্টিকারী এ ধরনের ‘সাজানো’ সড়ক অবরোধ বা বিক্ষোভ কর্মসূচির বিষয়ে কঠোর হবে।
গতকাল ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের (ডিএমপি) পক্ষ থেকে এ সংক্রান্ত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে রাস্তা অবরোধ করে যানচলাচলে বিঘ্ন সৃষ্টি না করার জন্য অনুরোধ জানানো হয়।
বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘সম্প্রতি রাজধানীতে বিভিন্ন গোষ্ঠী ও কতিপয় স্বার্থান্বেষী মহল দাবি-দাওয়া আদায়, প্রতিবাদ কর্মসূচি ইত্যাদি নামে যখন-তখন সড়ক অবরোধ করছেন। এতে ঢাকা মহানগরে তীব্র যানজটের সৃষ্টি হচ্ছে, ফলে স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী ও অফিসগামী যাত্রীরা নানা বিড়ম্বনার সম্মুখীন হচ্ছেন। বিদেশগামী যাত্রী ও জরুরি প্রয়োজনে অসুস্থ রোগী পরিবহনে সৃষ্টি হচ্ছে মারাত্মক ব্যাঘাত। যানজট কমানোর জন্য ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের ট্রাফিক বিভাগ প্রাণান্তকর চেষ্টা করছে, তথাপি কারণে-অকারণে রাস্তা অবরোধ করার মতো ঘটনায় সৃষ্টি হচ্ছে ব্যাপক জনদুর্ভোগ।
এমতাবস্থায় সম্মানিত নগরবাসীর বৃহত্তর স্বার্থে এবং সুষ্ঠু ট্রাফিক ব্যবস্থাপনার নিমিত্তে অহেতুক সড়ক অবরোধ করা থেকে বিরত থাকার জন্য সংশ্লিষ্ট সবাইকে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের পক্ষ থেকে বিশেষ অনুরোধ করা হলো।’
এ প্রসঙ্গে ডিএমপির মুখপাত্র উপপুলিশ কমিশনার (ডিসি) মুহাম্মদ তালেবুর রহমান সময়ের আলোকে বলেন, রাজধানীর ব্যস্ততম সড়ক অবরোধ করে বিক্ষোভ করলে জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হয়, যা সংগত কারণেই কারও কাম্য নয়। তাই যানচলাচল স্বাভাবিক রাখতে এবং জনদুর্ভোগ সৃষ্টি হতে পারে এমন সব কর্মসূচি থেকে বিরত থাকতে সবাইকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। গত ৯ মাস রাজধানীতে সড়ক অবরোধ করে কতগুলো বিক্ষোভ সমাবেশ হয়েছে এমন প্রশ্নের তাৎক্ষণিকভাবে কোনো উত্তর জানাতে পারেননি তিনি।