—হযরত মুহাম্মদ সা.
১
উত্তাল ঢাকার প্রাণকেন্দ্র। গাজায় হত্যাযজ্ঞ বন্ধের দাবিতে বিশ্বব্যাপী যে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছিল ফিলিস্তিনবাসী, তার সাথে সংহতি জানিয়ে এই গণজমায়েত। একটা উত্তাল সমুদ্রের মতো মুহুর্মুহু গর্জে উঠছে মানুষের গর্জন। ফ্লাইওভার, রাস্তা, ফুটপাথ, বাড়ির ছাদ—গোটাটা ছেয়ে আছে মানুষে মানুষে। গলায় গর্জন আর হাতে ফিলিস্তিনের পতাকা। উত্তাল এই সমুদ্রের মধ্যে আমিও আছি, একটা বিন্দু হয়ে।
জনস্রোত একটু একটু নড়ছে, একটু একটু এগুচ্ছে। আমিও সেই তালে নড়ছি, সরছি। গলার সবকটি রগ ফুলিয়ে চিৎকার করছি—ফিলিস্তিন জিন্দাবাদ, ফিলিস্তিন জিন্দাবাদ! ফ্রি ফ্রি ফিলিস্তিন।
ছোট ছোট বাচ্চাগুলোর কারো হাত নেই, কারো মাথা নেই, কারো বুক ভেদ করে গেছে বুলেট; সেই ফুটো দিয়ে দেখা যাচ্ছে ফিলিস্তিনের বিধ্বস্ত ভূমি। ফিলিস্তিনের পিঁপড়া পর্যন্ত বাঁচার জন্য বিশ্বের দিকে তাকিয়ে আছে!
ঘামে ভেজা, পিপাসার্ত শরীরে হঠাৎ কেমন একটা ঠান্ডা অনুভূত হলো। ঠান্ডা স্বাদটা পরক্ষণে মনে হলো কেমন নোনতা নোনতা। চৈতন্য হলে বিধ্বস্ত ফিলিস্তিনে নিজেকে একটা গাছ হিসেবে আবিষ্কার করলাম। দেখলাম আমার গোড়ায় একটা তরুণ মাটিতে হামাগুঁড়ি দিয়ে এসে হেলান দিলো। সে কঁকাচ্ছিল, তার পাঁজর থেকে দরদর করে বেরুচ্ছিল রক্ত। রক্তে রঞ্জিত হয়ে যাচ্ছিলাম আমি। আমার খুব মন চাচ্ছিল, আমি তাকে কোলে তুলে নিই। তার সেবা করি। কিন্তু আমি তো গাছ, আমার হাত নেই, পা নেই। বসে বসে তার মৃত্যুর জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আমার আর কিছু করার ছিল না।
জীবনে এই প্রথম কোনো তাজা প্রাণের এভাবে মরে যেতে দেখছি। ছেলেটার রক্তরাঙা সাদা স্লিপলেস টি-শার্ট, মোবাইল প্যান্ট শরীরের সঙ্গে লেপটে আছে। একগুচ্ছ চুল মুখের সঙ্গে লেপটে আছে। সেখানে একফোঁটা পানির জন্য কাতরতা আছড়ে পড়ছে।
দ্রুম করে এক শব্দে আমার দৃষ্টি আকৃষ্ট হলো। আমি সামনের দিকে চাইলাম। একদলা ধোঁয়ার কুণ্ডুলি আকাশের দিকে উড়ে যাচ্ছে। ধোঁয়ার মধ্যে মুহুর্মুহু আগুনের ফুলকি চমকাচ্ছে। সেই অগ্নিচমকের মধ্য থেকে ছলকে উঠছে অসংখ্য মানুষের চিৎকার। এর চারদিকে যতদূর চোখ যাচ্ছে শুধু ধ্বংসযজ্ঞ চোখে পড়ে। দালানের পর দালান ধূলিস্যাৎ হয়ে গেছে। আমার চোখ ধ্বংসন্তুপের পেটর ভেতর সেঁধিয়ে গেল। হঠাৎ ধ্বংসস্তূপের ভেতর একটা শব্দ কানে এলো। আর্তনাদের মতো। যেন কেউ কাতরাচ্ছে। একটু পরে ধুয়ার কুণ্ডুলি থেকে একটা অবয়বকে দেখলাম বেরিয়ে আসছে। কিছু পরেই অবয়বটা আমার চোখের সামনে স্পষ্ট হয়ে উঠল।
একজন নারী। মাথা থেকে তার দরদর করে রক্ত ঝরছে। মাথার নেকাব এলোমেলো হয়ে মাথার পেছনে হেলে পড়েছে। হামাগুঁড়ি দিয়ে সে এগিয়ে আসছে। একটু পর যখন আরও স্পষ্ট হয়ে উঠল ওই মহিলার অবয়ব এবং তার কোলের রক্তপিণ্ডটা। কোল থেকে দুইটা হাত দুলছে। নির্জীব শিশুর ছোট্ট হাত দুইটা মনে হলো আমাকে ডাকছে।
(নিজের অসহায়ত্ব আমি টের পেলাম। আমি একটা গাছ। আমার শেকড় মাটির সঙ্গে গ্রোথিত। সেই শেকড়ে আমি মাটির গভীর থেকে আমার আহারের জল টেনে নিই। সেই জলের স্বাদ ছিল ঠান্ডা। কিন্তু হঠাৎ আমার সেই খাবারের স্বাদ পালটে গেছে। সেই স্বাদটায় যোগ হয়েছে রক্তের নোনতা স্বাদ। আমি শেকড়ে অনুভব করি ফিলিস্তিনের পাঁজরজুড়ে পানির স্বাদ পালটে গেছে। সেখানে যোগ হয়েছে রক্তের নোনতা স্বাদ। আমি একটা ফিলিস্তিনি বৃক্ষ। আমার গোড়ায় মুমূর্ষু এক তরুণ পানির জন্য হাহাকার করছে। এই ছেলেটার শৈশব আনন্দ আর হাসি-খেলায় কেটেছিল আমার তলায়। ওই যে মা তার মৃত সন্তানকে নিয়ে হামাগুঁড়ি দিয়ে এগিয়ে আসছে। সে আমার দিকেই আসছে। একদা সে তার প্রেমিকের সঙ্গে দেখা করতে আমার আড়ালকেই ব্যবস্থা হিসেবে নিয়েছিল।)
মা যখন তার সন্তানকে নিয়ে আমার গোড়ায় এসে পৌঁছাল, তখন মুমূর্ষু তরুণ পানি পানি বলে চিৎকার করছিল। মা তার সন্তানের লাশ তরুণের পাশে রেখে আতিপাতি পানি খুঁজল। পেল না। পুরো ফিলিস্তিন যে শুকনো মরুভূমি। যেটুকু জলীয় পদার্থ, তা ওই রক্ত—তাও মাটি গ্রাস করেছে।
তরুণের প্রাণ গলায় এসে বেরুবার জন্য ছটফট করছে। মা উপায় খুঁজছেন কীভাবে এই তরুণ প্রাণটা বাঁচানো যায়। একদা তিনি ব্যর্থ হয়ে ফিরে এলেন। তরুণের মুখপানে চাইলেন। তার মনে হলো, তরুণের মুখটা হঠাৎ যেন শিশুর মতো হয়ে গেছে। মনে হলো তার মৃত সন্তানের মুখটা কে যেন এই তরুণের মুখে বসিয়ে দিয়ে গেছে।
মা তরুণের মুখটা নিজের কোলের উপর তুলে নিলেন। তার হিজাব সরিয়ে বুকের কাপড় সরিয়ে নিলেন। মায়ের চোখ থেকে দু’ফোটা জল টপটপ করে রক্তে মুদে আসা তরুণের চোখের উপর পড়ল।
ঠিক তখনই ‘দ্রুম’ করে একটা শব্দ! পৃথিবীটাকে মনে হলো তীব্রভাবে কেউ নাড়িয়ে দিলো। একদলা অগ্নিকুণ্ড আমার অস্তিত্বের উপর হুড়মুড় করে এসে পড়ল। আমার অনুভূতি একযোগে চিৎকার করেই থেমে গেল।
২
নারকেল আর সুপুরি গাছের সারি। মাঝ দিয়ে সবুজ পথ; পথের মাঝে পায়ে হাঁটার একটা ছোট্ট এটেল মাটির পথ। তারপর ছোট্ট একটা উঠোন। উঠোন ঘিরে আছে চারটা ঘর। একটা মাটির, দুইটা টিনের আর একটা হাফ বিল্ডিং। মাটির ঘরে মেঝেতে পাটের ছালা বিছিয়ে বসে আমি। মায়ের চামচ নাড়ানোর শব্দ শুনছি।
মা বললেন, মাথা দেই বাবা?
না, মা। এটা তুমি খেয়ো বা বাবাকে দিও। আমি বলি।
মা আমাকে আরেক চামচ ভাত দিয়ে বলেন, সাফওয়ানকে টিকা দিতে নিয়ে যাব বাবা, দ্রুত খাও।
সাফওয়ান আমার সন্তান। মা তার নাতিকে নিয়ে টিকা দিতে নিয়ে যাবে। তাই আমাকে দ্রুত খেতে বলছেন। আমি দ্রুত খাবার শেষ করি। খেয়ে হাফ বিল্ডিং ঘরটার দক্ষিণের রুমটায়, যেখানে সাফওয়ানের মা, আমি আর সাফওয়ান থাকি, এসে হাত-পা ছড়িয়ে শুয়ে পড়ি। সবুজ দেয়ালে কাঁধভাঙা একটা ঘড়ি টিকটিক করে ক্রমাগত ঘুরে যাচ্ছে, মাথার উপর ঘুরছে ফ্যান। কোনো ফার্নিচারে কুটকুট করে কেটে চলেছে ঘুণ।
সাফওয়ানের মা বোধ হয় বাচ্চার ত্যানা-কাঁথা ধুচ্ছে। ভুট্টার আবাদ সেরে বেচাবিক্রিও শেষ করে কেবলই হাত-পা গুটিয়ে বসেছি। এখন কিছু দিন কোনো কাজ নেই। একটু আরাম-আয়েশ করে কাটাব ক’টা দিন।
মোবাইলটা হাতে নিয়ে অন্তর্জালে ঢুকতেই শরীর-মন অবশ হয়ে এলো। এ কী দেখছি! ফিলিস্তিনের গাজা উপত্যকায় ইসরায়েলি সেনাদের একটি অ্যাম্বুলেন্সে নির্বিচারে গুলি চালানোর ভিডিও প্রকাশিত হয়েছে। ঘটনায় ১৫ জন চিকিৎসাকর্মী নিহত হয়েছেন।
সোশ্যাল মিডিয়ায় আরেকটি ছবি বারবার ভেসে আসছে। সে ছবি ঘুরে বেড়াচ্ছে সোশ্যাল মিডিয়াজুড়ে। সব ভয়ংকর দৃশ্যকে ছাড়িয়ে গেছে সে দৃশ্য। বোমা ফেলা হয়েছে বিধ্বস্ত ফিলিস্তিনে। বোমার আঘাত অনেক মানুষকে শূন্যে ছুড়ে ফেলেছে। মানুষগুলো দেখলে মনে হবে, তারা যেন আকাশের পানে উড়াল দিয়েছে। এ যেন মানবতার বুলিদান করা নিষ্ঠুর মানুষের নিষ্ঠুরতম আচরণের প্রতি অসহ্য নির্বিকারত্ব। এই নির্বিকারত্ব যেন আমার, আমার প্রতি, আমার জন্য তাদের পক্ষ থেকে।
ইদানীং এসব দেখলে আমি কেন যেন ক্লান্ত বোধ করি। জীবনকে মনে হয় দুর্বহ বোঝা। সেই বোঝার চাপ কর্মক্লান্ত আমার শরীর নিতে পারে না। আমি আমার সন্তানের বালিশ বুকে নিয়ে নিঃশব্দে কাঁদতে থাকি এবং ঘুমিয়ে পড়ি।
ঘুম ভেঙে দেখি সে এক ভয়াবহ দৃশ্য। আমি একটা বিধ্বস্ত বাড়ি হয়ে গেছি। বাড়িটার আশি ভাগ বোমার আঘাতে উড়ে গিয়েছে। একদিকে একটা রুম এখনও অক্ষত; সেই রুমটার ঘাড়ের উপর বিধ্বস্ত পাঁচ তলার বোঝা চেপে আছে। সেই বোঝাসহ চার দেয়াল আর ছাদটা নিয়ে আমি দাঁড়িয়ে আছি। আশপাশে ‘ধ্রিম ধ্রিম’ শব্দ হচ্ছে। যেন পৃথিবীর শেষ সময় এসে গেছে। ঘড়বাড়ি, পাহাড় তুলার মতো উড়ছে। প্রতিটি বোমার আঘাতে আমার ভিত ঠকঠক করে কাঁপছে।
একটু পরে সে এক অভাবনীয় দৃশ্যের অবতারণা। আমার এই বিধ্বংস, বিধ্বস্ত রুমের ভেতর এক এক করে আসতে শুরু করল ছোট, বড় আর বৃদ্ধ মানুষগুলো। মা আসছে সন্তান কোলে, বাবা আসছে সন্তানের হাত ধরে, বৃদ্ধ আসছে তার লাঠিটা নিয়ে, তরুণ, তরুণী সবাই—বিধ্বস্ত বাড়ির দরজা জানালা দিয়ে তারা এসে আশ্রয় নিচ্ছে আমার এই ধ্বস্ত বুকটায়। আমার খুব ভয় হচ্ছে। এই না জানি একটা বোম এসে পড়ল!
আমি বুঝতে পারি তাদের মনের অবস্থা। এমন বিবদমান অবস্থায়, যেখানে একটা জায়গা নেই নিরাপদ, সেখানে একজন মানুষ যদি কোনো দিকে যায়, যেমন এই আমার এই রুম, সবাই ভাবতে থাকে হয়তো ওই জায়গাটা নিরাপদ। এখানেও তাই হয়েছে। ফলে সবাই এসে এখানে ঢুকেছে।
সবার শরীর ঘামে জবজব করছে। গায়ের কাপড় ধুলায় ধূসর। এখানে সেখানে কেটে রক্ত ঝরছে। এক তরুণের বা-পায়ের বা-দিকের মাংসে বিরাট একটা হা। কেটে রক্ত ঝরছে। রক্ত থামানোর চেষ্টায় সে ক্ষতে মেঝের ধুলা ঠেসে দিচ্ছিল।
পাশে থেকে বৃদ্ধ তার কাণ্ড দেখে বললেন, এই, এসব দিও না। ইনফেকশন হবে!
বৃদ্ধের কথায় সবাই তার দিকে তাকিয়ে থাকে। বৃদ্ধ কথাটা বলেই বুঝতে পারে কথাটা তার ঠিক হয়নি। পেটে খাবার নেই। পিপাসায় পানি নেই। গায়ের কাপড় নেই। শোবার জায়গা নেই। সব খালি নেই নেই। সেই নেই-এর দুনিয়ায় ওষুধ, ইনফেকশনের কথা যে কতটা বিলাসিতা—কথাটা বলার পরেই বৃদ্ধ বুঝতে পারে, অন্যরাও বুঝতে পারে এটা বৃদ্ধের ইচ্ছাকৃত না। অভ্যাসবশত, মুখ ফসকে বলে ফেলা।
বৃদ্ধের রেখায়িত মুখটা বিধ্বস্ত ফিলিস্তিনের মতোই দেখতে। মাথাটা কুমড়োর মতো সামনের দিকে ঝুলে পড়েছে। সে তার হাতের লাঠি দিয়ে কতগুলো ইটের টুকরোয় গুঁতো দিতে চেষ্টা করে। কম্পিত হাতে সে তার লক্ষ্য স্থির করতে পারে না।
বৃদ্ধের অবস্থা দেখে তার দিকে এগিয়ে যায় এক মাঝবয়সী লোক। পাশে বসে বৃদ্ধের পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। এবার বুঝি বৃদ্ধ আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। হু-হু করে সে কেঁদে ওঠে।
কাটা গায়ে ময়লা ভরতে থাকা তরুণ বৃদ্ধের দিকে একবার চোখ বুলিয়ে ফের নিজের কাজে ডুবে যায়।
ঠিক তখন, তখনই একটা বোমা এসে আমার বিধ্বস্ত ঘাড়ের উপর আছড়ে পড়ে। আমি নিচের দিকে মিশে যেতে থাকি আর পুটপুট করে শুনতে পাই মানুষের খুলিগুলো ফেটে যাবার শব্দ। এক নিমেষে এক রুম ভর্তি মানুষ নিষ্প্রাণ আমার পাঁজরের অংশ হয়ে যায়।
হঠাৎ আমি টের পাই, কে যেন বিধ্বস্ত আমার পাঁজর খুড়ছে। কাটা পায়ের সেই নির্বিকার তরুণ। সে ধ্বংসস্তূপ থেকে বেরুবার জন্য একটা একটা করে সে ইট সরাচ্ছে।
৩
আমি যুদ্ধাহত একটা পিঁপড়া। আমি ফিলিস্তিনি। ফিলিস্তিনি এক পিঁপড়া। ইসরাইলি আগ্রাসনে আমার একটা পা উড়ে গেছে আর একটা পা ক্ষতিগ্রস্ত। আমি ধ্বংসপ্রাপ্ত এই বাড়িটিতে থাকি। এখানের আর কিছুই অবশিষ্ট নেই।
আমি সব আতিপাতি করে খুঁজেছি। কিচ্ছু নেই। যার ঘরের কোনায় আমি আর আমার সমাজের সবাই মিলে থাকতাম, সেই সুঠামদেহী ছেলেটার রুমটা একটা ধ্বংসস্তূপ। সে তরুণকে আজ আমার মনে পড়ছে, সে কতই না দরদী ছিল। এমন একটা দিন যায় নি যে ভুলে বেরিয়ে গেছে আর আমাদের জন্য খাবার রেখে যায়নি।
প্রতিদিন সকালে সে পাখিদের জন্য জানালায় গমের দানা ছিটিয়ে, ঘরের কোণে আমাদের জন্য এক টুকরা মিছরি দানা রেখে আর খরগোসকে ঘাস দিয়ে বাসা থেকে বেরিয়ে যেত। স্লিভলেস টি-শার্ট আর মোবাইল প্যান্ট পরে ড্রেসিং টেবিলের আয়নায় সে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে নিজেকে দেখত। আমার হাসি পেত। কী পাগল ছেলেটা! সেই পাগল ছেলেটা আজ কোথায়?
আমি আমার সমাজের বা পরিবারের কাউকে আর পাচ্ছি না। আমার দুঃখের সীমা নেই। কিন্তু তার চেয়েও দুঃখ লাগছে খালাম্মার জন্য, ওই ছেলেটার মায়ের জন্য। খালাম্মা চা বানাতে গেলেই কিছু না কিছু চিনি ফেলত, আমি আমার বন্ধুবান্ধব মিলে ওগুলো নিয়ে আসতাম। এখানে না ছিল খাবারের অভাব, না ছিল বাড়ি থেকে তাড়ি দেওয়ার ভয়।
আমি আমার দাদার কাছে শুনেছি, তারা নাকি কোনো বাড়ি থেকে তাড়া খেয়ে এসে এখানে আশ্রয় নিয়েছিল। নিজের ঘর থেকে তাড়িয়ে দেওয়ার মতো বেদনাদায়ক নাকি কিছু নেই—তা আসলে আমি সেভাবে বুঝতাম না। জানতামও না হয়তো। নিজের ঘর থেকে তাড়া খেয়ে পালিয়ে ঘরহীন হয়ে, অন্নহীন হয়ে ঘুরে বেড়ানো যে কতটা বেদনাদায়ক—এবার আমি তা টের পাচ্ছি।
মাথায় এসব ভাবনাচিন্তার বোঝা নিয়ে লেংচা লেংচাতে ধ্বংসস্তূপের উপর দিয়ে আমি অবিরাম হাঁটছিলাম। নাকে তখনই সেই পরিচিত ঘ্রাণটা এসে ঝাপটা মারল। আমি আরও দ্রুত চলতে চেষ্টা করলাম। উলটে পড়ছি, গড়িয়ে পড়ছি আর এগিয়ে চলেছি।
একটা সময় এসে থামতে হলো। এটা কী সেই পাকের ঘর নাকি? বোঝা যাচ্ছে না। গন্ধও ঠাহর করা যাচ্ছে না। কারণ এখন চারদিকে কেবল বারুদের গন্ধ। একটা ইটের স্তূপ দিয়ে ওঠার চেষ্টা করছি। কয়েকবার চেষ্টার পর একটা দেয়ালের তল দিয়ে এগিয়ে গেলাম। এবার আমাকে থমকে যেতে হলো। চারদিকে তৈজসপত্রের গুঁড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। খালাম্মা ইটপাথরে নিচে চাপা পড়ে আছে। আমি আর নিজেকে ধরে রাখতে পারলাম। তার একটা চুল ধরে অনেক কষ্টে উঠে এলাম মুখের কাছে।
খালাম্মা চেয়ে আছেন। তার চোখের পলক পড়ছে না। আর কোনো দিন হয়তো পড়বেও না। মুখে ছোট্ট একটা বেদনার হাসি। আমি আস্তে আস্তে তার চোখের পাঁপড়ির ওপর উঠলাম। চুমু দিলাম। ফের যেই চুমু দিতে যাব তখনই দ্রুম করে একটা শব্দ। শব্দটা যেন হলো আমার কলিজার মধ্যে। হুড়মুড় করে একটা ধ্বংসস্তূপ এসে পড়ল আমার ওপর।
আমি খালাম্মার সঙ্গে মিশে যেতে যেতে বললাম, মা, আমাকে ক্ষমা করো! আমি তোমার জন্য কিছু করতে পারলাম না।
৪
আমি এক ফিলিস্তিনি গাছ। আমার পেছনে কত শিশু, মা, বাবা, তরুণ, যুবা, বৃদ্ধ ভাইবোন আশ্রয় নিয়েছিল। আমি তাদের আড়াল দিয়েছিলাম। হয়তো রক্ষাকবচ হতে পারিনি। আমিই সেই গাছ বাংলাদেশের মিছিল থেকে যে হঠাৎ নাই হয়ে একদিন ফিলিস্তিনে গাছ হয়ে আবির্ভূত হয়েছিলাম। আমিই সেই গাছ, যাকে একটা বোমা দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হয়েছিল। যে গাছের নিচে মা এক তরুণের মৃত্যুপিপাসা মেটাতে নিজের বুককে উজাড় করে দিয়েছিল।
৪ Responses
Awesome https://is.gd/N1ikS2
Awesome https://is.gd/N1ikS2
Very good https://is.gd/N1ikS2
Awesome https://is.gd/N1ikS2