শুক্রবার (২২ আগস্ট) দুপুর ১২টার দিকে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের কুমিল্লার বিশ্বরোড-সংলগ্ন রামপুর এলাকার ইউটার্নে লরিচাপায় প্রাইভেট কারের চার আরোহীর সবাই নিহত হন। তারা হলেন জেলার বরুড়া উপজেলার হোসেনপুর গ্রামের ৮০ বছর বয়সী উমর আলী, তার স্ত্রী নুরজাহান বেগম (৬৫), তাদের বড় ছেলে আবুল হাসেম (৫০) এবং আরেক ছেলে আবুল কাশেম (৪৫)। এর মধ্যে আবুল হাসেম প্রাইভেটকারটি চালাচ্ছিলেন। বাবা-মায়ের চিকিৎসা শেষে তাদের নিয়ে বাড়ি ফিরছিলেন দুই ভাই।
এ দুর্ঘটনার পর ‘বিপজ্জনক’ ইউটার্নটি সাময়িকভাবে বন্ধ করা হয়। পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সেডান কারটি উল্টো পথে নয়, সঠিক লেনেই ছিল। এটি ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কের চট্টগ্রামমুখী লেন থেকে ইউটার্ন নিয়ে ঢাকামুখী লেনে আসার সময় সেটিকে চাপা দেয় দ্রুতগতিতে আসা লরিটি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া সিসিটিভি ফুটেজে এ দৃশ্য দেখা যায়। যদিও ঘটনার পর হাইওয়ে পুলিশের সদস্যরা ও স্থানীয় লোকজন দাবি করেন, ব্যক্তিগত মালিকানাধীন গাড়িটি উল্টো পথে যাচ্ছিল। এসব উঠে এসেছে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) প্রাথমিক পর্যালোচনায়।
কয়েক ঘণ্টার ব্যবধানে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়া সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, প্রাইভেট কারটি পদুয়ার বাজার বিশ্বরোড–সংলগ্ন উত্তর রামপুর এলাকায় ইউটার্ন নেয়ার চেষ্টা করছিল। এ সময় ঢাকামুখী লেনে উল্টো পথে যাচ্ছিল হানিফ পরিবহনের যাত্রীবাহী একটি এসি বাস। এমন সময় চট্টগ্রামের দিক থেকে ঢাকামুখী লেনে দ্রুতগতিতে যাচ্ছিল ওই লরিটি। প্রাইভেট কারটি ইউটার্নে প্রবেশ করতেই উল্টো পথে আসা হানিফ পরিবহনের বাস দেখে ইতস্ত হয়ে পড়েন সেডানের চালক। এতে কয়েক সেকেন্ড সময় নষ্ট হয়ে যায়। তবে দ্রুতগতিতে আসা লরির চালক গতি কমিয়ে আনতে ব্যর্থ হলে সেটি উল্টে যায়। গোটা লরিটি উল্টে গেলে সেটির সিমেন্টবোঝাই কনটেইনারের নিচে প্রাইভেট কারটি চাপা পড়ে। এতে ঘটনাস্থলেই সব আরোহী নিহত হন। একই সময় ওই লরির নিচে চাপা পড়ে সিএনজিচালিত অটোরিকশার চালক ও দুই যাত্রী গুরুতর আহত হন।
এ প্রসঙ্গে বুয়েটের দুর্ঘটনা গবেষণা ইনস্টিটিউটের (এআরআই) পরিচালক এবং পুরকৌশল বিভাগের অধ্যাপক এম শামসুল হক চ্যানেল 24 অনলাইনকে বলেন, ‘মাথা (হেড) এবং বডির সঙ্গে একটি হিঞ্জ বা জয়েন্ট দিয়ে জোড়া লাগানো এমন লম্বা যানকে সাধারণত আমাদের দেশে লরি বলা হলেও আন্তর্জাতিকভাবে এদেরকে বলা হয় আর্টিকুলেটেড ভেহিক্যাল বা সেমি ট্রেইলার। মূলত কনটেইনারবাহী এসব যান দ্রুত চলতে পারে না। এদের চালকের পক্ষে হার্ড ব্রেক করা মোটেই উচিত নয় কারণ এতে লরিটি উল্টে যাবে বা নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এসব লং ভেহিক্যালের খুব আশপাশে কারো থাকা নিরাপদ নয়। এসব বিশেষ যান চালানোর কোন ধরনের প্রশিক্ষণ কর্মসূচি নেই দেশের পরিবহন নিয়ন্ত্রক সংস্থা বিআরটিএ-র।
শেষ মুহূর্তে লরির আতঙ্কিত চালক সংঘর্ষ এড়াতে পেনিকড হার্ড ব্রেক ধরতে চান। আর এতেই লরিটি তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যান এবং তাৎক্ষণিক কাঁত হয়ে প্রাইভেট কারের ওপর পড়ে যায়।’
পরিবহন বিশেষজ্ঞ ড. এম শামসুল হক আরও বলেন, ‘ট্রেনের লোকোমোশনের (ইঞ্জিন) সঙ্গে এর বগি (কম্পার্টমেন্ট) একটি জয়েন্ট বা হিঞ্জ দিয়ে সংযুক্ত থাকে। একইভাবে বগির সঙ্গে এর পরবর্তী বগিও হিঞ্জ দিয়ে সংযুক্ত থাকে। তাই রেলগাড়ির চালক (লোকো মাস্টার) দ্রুত ব্রেক কষতে চাইলেও পারেন না। কারণ তা করতে গেলে বগিগুলো একটি অপরটির উপর উঠে যেতে পারে। তবে বিশেষ তারযুক্ত একটি আলাদা কানেকশন ইঞ্জিন থেকে বগি হয়ে সবশেষ বগি পর্যন্ত টানা থাকে। এটি কোন কারণে ছিঁড়ে গেলে ট্রেন ধীরে ধীরে থেমে যায়।
এই লরিতেও এমন একটি কানেকশন থাকার কথা। ধারণা করা হচ্ছে এর মাথা (ইঞ্জিনসহ ফ্রন্টাল চেম্বার) এবং বডিটি আলাদাভাবে প্রস্তুত করা হয়েছিল। ফ্রন্টাল চেম্বার বা চালকের চেম্বারটি ভারত থেকে আনা হয়ে থাকতে পারে আর কন্টেইনার বহনকারী অংশটি দেশীয়ভাবে তৈরি হয়ে থাকতে পারে। তাই এর দুই অংশের মধ্যকার বিশেষ তারযুক্ত সংযোগটি সঠিকভাবে কার্যকর ছিল না।’
লরি চালকের পাশাপাশি সেদিনের দুর্ঘটনায় বড় অপরাধটি করেছে হানিফ পরিবহনের বাসচালক। সিসিটিভি ক্যামেরা না থাকলে এমন অপরাধীদের (কালফ্রিট) শনাক্ত করা হয়তো সম্ভবপর হতো না। পুরো দুর্ঘটনা নিজের চোখে দেখেও তিনি রং সাইড থেকে ঠিক লেনে এসে বাস চালিয়ে চলে যান। যেনো কোন কিছুই ঘটেনি। দুর্ঘটনায় এরা মূল হোতা (ইনস্টিগেটর) হিসেবে ন্যক্কারজনক ভূমিকা রাখে। আর অনেক সময়ই থেকে যান ধরাছোঁয়ার বাইরে।
অধ্যাপক আরও বলেন, ‘এমন সব দুর্ঘটনায় কাউকে এককভাবে দায় চাপিয়ে দেয়া আমাদের কাজ নয়। দুর্ঘটনার যথাযথ পর্যালোচনার পাশাপাশি এবং এমন সব দুর্ঘটনা যেন ভবিষ্যতে আর না ঘটে সেই পরামর্শ দেয়া।’
এদিকে ব্যস্ততম এসব মহাসড়কের এমন ইউটার্নের নকশায় বড় ধরনের ত্রুটি রয়েছে। সেই সঙ্গে অপ্রশিক্ষিত চালক এবং ফিটনেস বিহীন গাড়ি তদারকির দায়িত্বরত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বহিনীর দায়িত্বে অবহেলা রয়েছে।
স্বজনহারা পরিবারের সদস্যরা জানিয়েছে, প্রাইভেট কার ইউটার্ন করে একটু সামনেই থাকা কুমিল্লা-চাঁদপুর সড়ক হয়ে বাড়ি ফেরার কথা ছিল ওই চারজনের। এদিকে, এ ঘটনায় শুক্রবার রাতে নিহত ওমর আলীর ভাই আবুল কালাম বাদী হয়ে সড়ক পরিবহন আইনে কুমিল্লা সদর দক্ষিণ মডেল থানায় মামলা করেন। মামলায় লরি ও উল্টো পথে আসা হানিফ পরিবহন বাসের অজ্ঞাতনামা চালকদের আসামি করা হয়।
সিসিটিভি ফুটেজে দেখা যায়, দুর্ঘটনার জন্য লরি ও হানিফ পরিবহনের বাসের চালক দায়ী। মামলার অভিযোগে নিহত ওমর আলীর ভাই দুই চালকের কথা উল্লেখ করেছেন। তাদের আটকের চেষ্টা চলছে। প্রাইভেট কারটি ইউটার্নের সময় লরিটি দ্রুতগতিতে আসায় এবং উল্টো পথে হানিফ বাস আসায় এমন ঘটনা ঘটেছে।
এর আগে, বুয়েটের এই অধ্যাপক বলেন, ‘বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ এখন বলছে দুর্ঘটনায় ইনস্টিগেটর হিসেবে দায়ী এসব যান (ব্যাটারিচালিত থ্রি-হুইলার) এখন নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে। তারা কেন এই ক্যানসার শুরুতে আচঁ করতে পারেনি। অবৈধ এসব যান এখন আমাদের গোটা দেশের পরিবহনখাতে ক্যানসারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। শুরুতে যখন এদের সংখ্যা কয়েক’শ ছিল তখন কেন এসব নিয়ন্ত্রণ করা হলো না। বিআরটিসি কেন এটি বুঝতে পারেনি। এখন বলছে এটি তাদের নিয়ন্ত্রণের বাইরে।’
অধ্যাপক শামসুল হক আরও বলেন, ‘এসব অবৈধ যান উচ্ছেদের উদ্যোগ নিলেই একদল মানবতাবাদী মানুষ অটোচালক ও তাদের পরিবারের পক্ষ নেন। এই কয়েক হাজার লোকের সাময়িক জীবিকার চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ গোটা দেশের মানুষের যাতায়াতের সময়, নিরবচ্ছিন্ন আমদানি-রপ্তানি এবং দেশের অর্থনীতি। মহাসড়কের এমন বিশৃঙ্খল অবস্থা দেখে বিদেশি ক্রেতারা (বায়ার) এদেশ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন। আর যদি এসব অটোরিকশা তুলে দিয়ে কমপক্ষে মহাসড়কে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা যায় তখন এই অটো চালকদের আরও ভালো কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়ে যাবে।’
কা/ত/মা