শনিবার, রাত ২:২৪
১১ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ২৬শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ১৯শে রবিউস সানি, ১৪৪৭ হিজরি,

একজন আধ্যাত্মিক সংস্কারকের গল্প: সুফি আরেফ আলী মুনশী রহ.

|| নাফিস অলি ||

অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি পলাশীর প্রান্তরে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের কাছে পরাজয়ের মধ্য দিয়ে ভারতবর্ষে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হলে মুসলমানদের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে ঘোর অন্ধকার নেমে আসে। মুসলিম শাসকদের পতনের পর উপমহাদেশের মুসলমানদের সর্বাত্মকভাবে দমনের নকশা আঁকে ব্রিটিশরা। রাজনৈতিক ও সামাজিক নির্যাতনের পাশাপাশি তারা বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসনে মুসলিম সমাজকে ইসলামি তাহযিব ও তামাদ্দুন থেকে বিচ্যুত করার চেষ্টা চালায়।

সেই সময়ে শিরক-বিদআত, কুসংস্কার ও নানা অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডে ভরে ওঠে সমাজ। মুসলিম জাতির এই দুরবস্থা থেকে মুক্তির ডাক দেন হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী রহ., যাঁর হাত ধরে শুরু হয় ইসলাহি ও সংস্কার আন্দোলন। পরবর্তীতে হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মাক্কী, মাওলানা কাসিম নানুতুবী, হোসাইন আহমদ মাদানী, সাইয়েদ আহমাদ শহীদ, হাজী শরীয়ত উল্লাহ, মীর নিসার আলী তিতুমীর প্রমুখ নেতার হাত ধরে ভারতবর্ষ জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে সেই আন্দোলন। তবু ব্রিটিশদের জুলুম ও আগ্রাসনের মাত্রা কমেনি, বরং বেড়েছে। এভাবেই মুসলমানদের অবক্ষয় পৌঁছে যায় প্রত্যন্ত বাংলার জনপদেও।

এই ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে বিংশ শতাব্দীর শুরুতে বরিশালের বানারীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন বিশিষ্ট সংস্কারক ও ইসলাম প্রচারক সুফি আরেফ আলী মুনশী রহ.। শৈশবে পিতৃহারা হয়ে মাতৃস্নেহে বেড়ে ওঠেন তিনি। প্রাথমিক শিক্ষা শেষে দ্বীনি ও আধ্যাত্মিক জ্ঞান অর্জনের জন্য দেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন। বিশেষ করে চট্টগ্রাম অঞ্চলের উলামায়ে কেরামের কাছে তিনি শিক্ষা গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে জৈনপুরের পীর মাওলানা আব্দুর রব জৈনপুরী রহ. এবং তাঁর উত্তরসূরি মাওলানা হোসাইন আহমদ রহ.-এর নিকট আধ্যাত্মিক পাঠ গ্রহণ করে খিলাফত লাভ করেন।

দেশে দাওয়াত ও তাবলীগ আন্দোলনের সূচনা হলে তিনি এতে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন এবং বৃহত্তর বরিশালে এ কাজের পথিকৃত হয়ে ওঠেন। আমৃত্যু বানারীপাড়া-উজিরপুর অঞ্চলের প্রথম আমীর হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। কাকরাইল মসজিদে তাঁকে বলা হতো “বরিশালের সুফি সাহেব”।

রাজনৈতিক সঙ্কট ও সামাজিক অবক্ষয়ে দিশেহারা মুসলিম সমাজের প্রতি তিনি ছিলেন ভীষণ ব্যথিত। কুসংস্কার, বিদআত, জাহালাত ও শোষণে জর্জরিত সমাজের মুক্তির জন্য তিনি নিজেকে নিয়োজিত করেন। সত্য ও ন্যায়ের দাওয়াত দিতে সাধারণ মানুষের মাঝে নিরলসভাবে বক্তৃতা, আলোচনায় ছুটে বেড়াতেন। তিনি ছিলেন একাধারে সুবক্তা, দক্ষ সংগঠক ও নিবেদিত প্রাণ সংস্কারক।

মুসলিম নবপ্রজন্মকে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা ও ঐতিহ্যের সাথে পরিচিত করতে তিনি দ্বীনি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেন। ১৯৪৮ সালে নিজ গ্রামে প্রতিষ্ঠা করেন দারুল উলুম হোসাইনিয়া কওমিয়া কেরাতিয়া মাদরাসা, যা পরবর্তীতে বরিশালের কওমি শিক্ষার এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হয়ে ওঠে। তাঁর প্রচেষ্টায় আরও বহু মসজিদ ও মক্তব প্রতিষ্ঠা হয়। ২০০৬ সালে তাঁর স্মৃতিতে প্রতিষ্ঠিত হয় আরেফ আলী মুনশী এতিমখানা ও মাদরাসা।

সুফি আরেফ আলী মুনশীর জীবন ছিল ত্যাগ, ইবাদত ও সেবামূলক কর্মে ভরপুর। প্রিয় সন্তান হারানোর মুহূর্তেও তিনি দ্বীনি কাজ থেকে বিরত হননি—মাদরাসার ছাত্রদের দারিদ্র্যের কথা ভেবে ব্যক্তিগত শোককে আড়াল করেছেন। তাঁর দিন কাটত মানুষের কল্যাণে, আর রাত কাটত ইবাদতে। পথ চলতে চলতে বিশ্রাম নিতেন, কখনো ঘুমিয়েও পড়তেন। এভাবেই তিনি নিরন্তর দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ছুটেছেন।

১৯৭৮ সালের ১৭ই এপ্রিল সুফি আরেফ আলী মুনশী রহ. ইন্তেকাল করেন। পূর্ব সলিয়াবাকপুর গ্রামে তাঁর প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা মাঠেই সমাহিত হন তিনি। আজও তাঁর প্রতিষ্ঠিত শিক্ষাকেন্দ্র ও তাবলীগি কর্মকাণ্ড বরিশালসহ সারাদেশে আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে।

সুফি আরেফ আলী মুনশী রহ. ছিলেন তাঁর সময়ের এক অনন্য মনীষী, যিনি কওমি শিক্ষা প্রসার, সামাজিক সংস্কার ও ইসলামী চেতনার পুনর্জাগরণে অবিস্মরণীয় ভূমিকা রেখে গেছেন। তাঁর জীবন ও কর্ম আজও আমাদের জন্য পথপ্রদর্শক।

– শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।

কা/ত/মা

Facebook

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *