- নাফিস অলি
অষ্টাদশ শতাব্দীতে পলাশীর প্রান্তরে সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটিশদের নিকট পরাজয়ের মধ্য দিয়ে উপমহাদেশে স্বাধীনতার সূর্য অস্তমিত হলে মুসলমানদের সামাজিক ও ধর্মীয় জীবনে ঘোর অন্ধকার নেমে আসে। ইতোপূর্বে ভারতবর্ষের ক্ষমতার কেন্দ্রে থাকা মুসলমানদের যেকোনো উপায়ে দমনের সর্বাত্মক চেষ্টা গৃহীত হয়। সামাজিক ও রাজনৈতিক পীড়নের পাশাপাশি সাংস্কৃতিক ও ঈমান-আকীদাগত বিষয়ে ক্ষতিসাধনের সুদূর প্রসারী নকশা প্রণয়ন ব্রিটিশরা। সামাজিকভাবে মুসলমানরা যেমন নির্যাতন-নিপীড়নের শিকার হয়, একইভাবে বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসনে ইসলামী তাহযিব ও তামাদ্দুন থেকে বিচ্যুত হয়ে পড়ে। শিরক -বিদআত, কুসংস্কারসহ নানা অনৈসলামিক কর্মকাণ্ডে সয়লাব হয়ে যায় মুসলিম সমাজ। নিদারুণ অবক্ষয় থেকে দেশ ও জাতিকে রক্ষা করে হারানো গৌরব ফিরিয়ে আনতে সর্বপ্রথম প্রতিরোধ ও সংস্কার আন্দোলনের ডাক দেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত মুহাদ্দিস হযরত শাহ ওয়ালীউল্লাহ দেহলভী রহ.। এরপর তা ভারতবর্ষজুড়ে ছড়িয়ে পড়ে হাজী ইমদাদুল্লাহ মুহাজেরে মাক্কী, মাওলানা কাসিম নানুতুবী, মাহমূদ হাসান দেওবন্দী, হোসাইন আহমাদ মাদানী, সাইয়েদ আহমাদ শহীদ, মীর নিসার আলী তিতুমীর, হাজী শরিয়ত উল্লাহ, মুনশী মেহেরুল্লাহ প্রমুখের নেতৃত্বে। সংগঠিত হয় সিপাহী বিদ্রোহ, ফরায়েজি আন্দোলন, খিলাফত আন্দোলন, রেশমি রুমাল আন্দোলন, শামলীর যুদ্ধ ইত্যাদি। এতে জুলুম ও আগ্রাসনের মাত্রা বাড়ে বৈ কমে না। উপমহাদেশের সবুজ বৃক্ষকাণ্ড উলামায়ে কেরামের ফাঁসিকাষ্ঠে পরিণত হয়। অবক্ষয়ের চলমান ধারা ধীরে ধীরে পৌঁছে যায় প্রত্যন্ত জনপদগুলোতে।
এমনই এক ঝঞ্ঝাবিক্ষুব্ধ সময়ে বিংশ শতাব্দীর সূচনা লগ্নে বাংলার ভেনিসখ্যাত বরিশালের সন্ধ্যানদী বিধৌত বানারীপাড়ায় জন্মগ্রহণ করেন বিশিষ্ট সংস্কারক ও ইসলাম প্রচারক সুফি আরেফ আলী মুনশী রহ.। শৈশবে তিনি পিতাকে হারিয়ে মাতৃস্নেহে লালিতপালিত হন। তাঁর শৈশব, কৈশোর এবং প্রাথমিক শিক্ষা নিজ গ্রামেই সম্পন্ন হয়। অতঃপর দ্বীনি ও আধ্যাত্মিক শিক্ষা অর্জনের জন্য বিশিষ্ট শায়খদের সোহবত লাভে দেশের বিভিন্ন স্থানে ভ্রমণ করেন। প্রাচীনকাল থেকে আরব বণিকদের যাতায়াতের ফলে চট্টগ্রাম অঞ্চল ইসলামের উর্বর ভূমি ও বিশেষ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে ওঠে। সুফি সাহেব রহ. বারো আউলিয়ার পুণ্যভূমিখ্যাত বৃহত্তর চট্টগ্রাম তথা দক্ষিণবঙ্গের প্রসিদ্ধ উলামায়ে কেরামদের নিকট দ্বীনি শিক্ষা লাভ করেন এবং জৈনপুরের পীর মাওলানা আব্দুর রব জৈনপুরী রহ. (মৃত্যু ১৯৩৫ খ্রি.) -এর নিকট আধ্যাত্মিক পাঠ গ্রহণ করেন। পীর সাহেবের একান্ত সাহচর্যে দীর্ঘ সময় অতিবাহিত করে ইলমে তাসাওফের বিশেষ জ্ঞান লাভ করেন। স্বীয় মুর্শিদের ইন্তেকালের পর তদীয় পুত্র ও খলিফা মাওলানা হোসাইন আহমদ রহ. (মৃত্যু ১৩৫৮ হিজরি) -এর নিকট বায়আত গ্রহণ করেন এবং পরবর্তীতে এজাযত লাভ করেন।
বিগত শতাব্দীর চল্লিশের দশকে এদেশে দাওয়াত ও তাবলীগের আগমন ঘটলে তিনি তাতে যোগদান করেন এবং নিজ এলাকায় তাবলীগের সূচনা করেন। বৃহত্তর বরিশালে তাবলীগী কাজের পৃষ্ঠপোষকতার পাশাপাশি বর্তমান বানারীপাড়া-উজিরপুর উপজেলার প্রথম আমীর হিসেবে আমৃত্যু দায়িত্ব পালন করেন। কৃচ্ছ্রসাধন ও দুনিয়াবিমুখ অতি সাধারণ জীবনযাপনের ফলে বাংলাদেশে তাবলীগ জামাতের প্রধান কেন্দ্র কাকরাইল মসজিদে তিনি ‘বরিশালের সুফী সাহেব’ নামে পরিচিত ছিলেন।
বিংশ শতাব্দীতে চলমান রাজনৈতিক সঙ্কট ও সামাজিক অবক্ষয়ে মুসলমানদের দুর্দশা অবলোকন করে সুফি আরেফ আলী মুনশী রহ. ভীষণ ব্যথিত হন। বুদ্ধিবৃত্তিক আগ্রাসনের শিকার মুসলিম জাতি তখন ইসলামী আকীদা ও ঈমানী চেতনা ভুলে কুফুর-বিদআদসহ মারাত্মক সব গুনাহে লিপ্ত। চরম জাহালাত আর কুসংস্কারের অতল অন্ধকারে ডুবে পুরো সমাজ। নিম্নশ্রেণির মানুষের ওপর পুঁজিপতি শ্রেণির শোষণ আর ক্ষমতাবান-মহাজনদের জুলুম-নির্যাতন তখন নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। গণমানুষের অধিকার ভূলন্ঠিত। সমাজের দ্বীনি দুর্দশা এবং জুলুম-নির্যাতনে ক্লিষ্ট পীড়িত মুখ তাঁকে দারুণভাবে স্পর্শ করে। সংগ্রামী পূর্বসূরীদের আদর্শকে ধারণ করে তিনি সামাজিক সংস্কারে ব্রতী হন।
আত্মপরিচয় ভোলা মানুষকে জাগিয়ে তুলে তাদের সংগঠিত করার জন্য তিনি মানুষের মাঝে দাওয়াতের কাজ শুরু করেন। দ্বীনভোলা মানুষের অন্তরে জ্বালতে থাকেন প্রভুপ্রেমের অপার্থিব জ্যোতি। তিনি একজন সুবক্তা ও দক্ষ সংগঠক ছিলেন। সাধারণ মানুষের মাঝে দ্বীনি মূল্যবোধ ও ঈমানী চেতনা জাগ্রত করতে বিভিন্ন স্থানে বক্তৃতা-আলোচনার মাধ্যমে দাওয়াত দিয়ে মানুষকে সত্য ও ন্যায়ের ওপর অটল থাকার আহ্বান জানান। পরস্পর পরস্পরকে জাগিয়ে তোলার আকুতি সবার নিকট পৌঁছে দিতে তিনি ছুটে চলেন বিরামহীন।
মুসলিম নবপ্রজন্মকে ইসলামের মৌলিক শিক্ষা ও পূর্বপুরুষদের গৌরবময় ইতিহাসের সাথে পরিচিত করতে তিনি দ্বীনি শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠায় মনোনিবেশ করেন। তাঁর প্রচেষ্টায় বিভিন্ন স্থানে প্রতিষ্ঠা পায় মক্তব ও মসজিদ।
দাওয়াতি আন্দোলনের ধারা চালু রাখার পাশাপাশি দক্ষ ও মুখলেস দা’ঈ তৈরি, ইসলামের জন্য নিবেদিত বীর সেনানী সৃষ্টি, ইসলামের প্রচার এবং সহীহ দ্বীন ও আকীদার সংরক্ষণে ১৯৪৮ খ্রিষ্টাব্দে নিজ গ্রামে তিনি একটি ইসলামী শিক্ষাকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করেন। তাঁর প্রতিষ্ঠিত দারুল উলূম হোসাইনিয়া কওমিয়া কেরাতিয়া মাদরাসা বাংলাদেশে দেওবন্দি ধারার অন্যতম ঐতিহ্যবাহী শিক্ষাকেন্দ্র। তাঁর স্মৃতিতে ২০০৬ খ্রিষ্টাব্দে পূর্ব সলিয়াবাকপুর গ্রামে প্রতিষ্ঠিত হয় ‘আরেফ আলী মুনশী এতিমখানা ও মাদরাসা’।
তিনি ছিলেন তাঁর সময়ের অন্যতম শ্রেষ্ঠ মনীষী, ঊৎসর্গীপ্রাণ (Dedicated) শিক্ষা সংগঠক। অসাধারণ কর্মের দ্বারা তিনি অসংখ্য মানুষকে প্রভাবিত করেছিলেন। হয়ে উঠেছিলেন হাজারো মানুষের আত্মাধ্যিক রাহবার ও অনুসরণীয় ব্যক্তিত্বে। শোষণ-নিপীড়নমুক্ত স্বাধীনচেতা সমাজ নির্মাণের চেষ্টা, ক্লান্তিহীন ইসলাম প্রচার, শিক্ষা ক্যাম্পাস নির্মাণ ও ইসলামী শিক্ষা সম্প্রসারণে তাঁর সবিশেষ ত্যাগ (Sacrifice) এবং কারামতের ঘটনাবলী আজও কিংবদন্তী হয়ে এ অঞ্চলের লোকমুখে প্রচারিত। বহুল প্রচারিত একটি ঘটনা প্রণিধানযোগ্য- একে একে তাঁর সন্তানরা ইন্তেকাল করছে, কিন্তু তিনি মোটেও বিচলিত নন। এমন ভয়ানক সময়ে মহান প্রতিপালকের প্রতি সন্তুষ্ট থেকে তিনি দ্বীনী খেদমতে আত্মমগ্ন। একদা তাঁর অতি আদরের এক পুত্রসন্তানের মৃত্যু সংবাদ তাঁর কাছে পৌঁছে। তিনি লোকদের বলেন, আপনারা তাকে দাফনের জন্য প্রস্তুত করুন। আমি মাদরাসার কাজ শেষ করে আসছি। লোকেরা অবাক হয়ে জানতে চায়, এমন শোকের মুহূর্তেও কাজ থাকতে পারে? তাঁর দৃপ্তকণ্ঠ উত্তর, “আজ আমার কেবল এক ছেলে মারা গেছে। মাদরাসায় আমার আরও অনেক ছেলে না খেয়ে আছে।”
তার পুরো দিন কাটত মানুষের কল্যাণে। আর রাত ছিল শুধুই মহান রবের জন্য। বিছানায় খুব অল্প বিশ্রাম নিতেন। দিনে পথ চলতে চলতে ঘুমিয়ে নিতেন। একবার তিনি কয়েকজন সাথিকে নিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। পথিমধ্যে হঠাৎ চুপ হয়ে গেলেন। কাফেলার এক সাথি লক্ষ্য করলেন সুফি সাহেবের চোখ বন্ধ এবং তিনি এ অবস্থাতেই পথ চলছেন। সাথিরা বুঝতে পারছিলেন না তিনি ঘুমেচ্ছেন কিনা। পরীক্ষা করার জন্য এক সাথি রাস্তার মধ্যে দাঁড়ালেন। সামনে বাধা পেয়ে ঘুম ভেঙ্গে তিনি দাঁড়িয়ে গেলেন। অতঃপর আফসোস করে বললেন, ‘হায় কী করলে! আমি সুন্দর একটা স্বপ্ন দেখছিলাম।’
এই ছিল তাঁর অবস্থা। রাত ছিল তাঁর শুধুই মহান স্রষ্টার জন্য। দিন বরাদ্দ ছিল সৃষ্টির খেদমতের জন্য। এসময় তিনি দ্বীনের দাওয়াত নিয়ে মানুষের দ্বারে দ্বারে ছুটে বেড়াতেন। এর ফাঁকেই দু’ দণ্ড বিশ্রাম সেরে নিতেন পথ চলতে চলতে। বর্ষা, শীত কিংবা গ্রীষ্ম; এই ছিল তাঁর রুটিন।
জীবনব্যাপী দ্বীন ও ইসলামের অসাধারণ খেদমত আঞ্জাম দিয়ে ১৯৭৮ সালের ১৭ই এপ্রিল গণমানুষের চিরকল্যাণকামী মহান এই সাধক স্বীয় প্রতিপালকের আহ্বানে আখিরাতপাণে সফর করেন। পূর্ব সলিয়াবাকপুর গ্রামে তাঁর রক্তঘামা শ্রমে প্রতিষ্ঠিত মাদরাসা মাঠে তাঁকে দাফন করা হয়। বিশিষ্ট চরিত্র, বিনীত শিক্ষা ও পূণ্যময় জীবনস্মৃতি আজও মানুষকে আলোড়িত এবং অনুপ্রাণিত করে। পথ দেখায় ইয়াকিনের, ইনসাফের। তাঁর অক্লান্ত পরিশ্রমে গড়া কেরাতিয়া মাদরাসা দীর্ঘ সাত দশকের বেশি সময় ধরে বরিশালের প্রত্যন্ত এক গ্রাম থেকে দেশজুড়ে আলো ছড়িয়ে চলছে অবিরাম।
লেখক : শিক্ষার্থী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।