মঙ্গলবার, বিকাল ৩:৪৪
১লা জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ, ১৭ই আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ, ৬ই মহর্‌রম, ১৪৪৭ হিজরি,

তত্ত্বাবধায়কে স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে মতবিরোধ

সংসদ নির্বাচন নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে চায় বিএনপি জামায়াতে ইসলামি জাতীয় নাগরিক পার্টিসহ (এনসিপি) বেশিরভাগ দল। তবে স্থানীয় সরকার নির্বাচন কার অধীনে হবে তা নিয়ে মতবিরোধ দেখা দিয়েছে দলগুলোর মধ্যে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন চায় না বিএনপি। ঠিক বিপরীত অবস্থানে জামায়াত ও এনসিপি। তারা উভয়ই দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন চায়।
মঙ্গলবার (৩ জুন) রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সঙ্গে দ্বিতীয় ধাপের সংলাপ শেষে দলগুলোর তাদের মতামত তুলে ধরে গণমাধ্যমের কাছে।
রাজধানীর বেইলি রোডের ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে মঙ্গলবার (৩ জুন) রাষ্ট্রের বিভিন্ন ক্ষেত্রে সংস্কার প্রশ্নে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় পর্বের বিষয়ভিত্তিক আলোচনা শুরু হয়। বৈঠকে সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদ, নিম্নকক্ষে নারী আসন, সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি নির্ধারণ, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ ও কার্যপরিধির একটি অংশ নিয়ে আলোচনা হয়। সোমবার ছিল দ্বিতীয় পর্বের আলোচনার উদ্বোধনী। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে ঐকমত্যের ভিত্তিতে আগামী মাসে জুলাই সনদ তৈরির লক্ষ্য রয়েছে ঐকমত্য কমিশনের।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ জানান, তার দল চায় না তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হোক। এছাড়া তার দল মনে করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ তিন মাসের বেশি হওয়া উচিত নয়। যদিও কমিশন প্রস্তাব করেছে যে, তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ চার মাস হওয়া উচিত।
সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের ব্যাপারে তিনি বলেন, বিএনপি আস্থা ভোট, অর্থবিল, সংবিধান সংশোধনসহ তাতে জাতীয় নিরাপত্তা সংশ্লিষ্ট বিষয়ও অন্তর্ভুক্ত করতে বলেছে। যদি কোনো সময় যুদ্ধাবস্থা তৈরি হয়, তাহলে পার্লামেন্ট মেম্বাররা যেন তার জন্য ভোট দিতে পারেন, সেটা ৭০ অনুচ্ছেদে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন। এ ব্যাপারে আমরা নোট অব ডিসেন্ট দেবো।
এছাড়া তার দল সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি পদে প্রধান বিরোধী দল থেকে নিয়োগ দেওয়ার ব্যাপারে একমত নয় বলে জানান সালাহউদ্দিন আহমেদ। বিএনপির এই নেতা বলেন, কয়েকটি কমিটিতে প্রধান বিরোধী দল থেকে নিয়োগ দেওয়া যেতে পারে, তবে সব স্থায়ী কমিটিতে প্রধান বিরোধী দল থেকে নিয়োগ দেওয়াকে তারা বাস্তবসম্মত প্রস্তাব মনে করেন না। সালাহউদ্দিন আহমেদ জানিয়েছেন, তারা এখনো সংসদে নারী আসন নিয়ে কোনো আলোচনা করেননি।
নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার পক্ষে মত দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। দলটির নায়েবে আমির ডা. সৈয়দ আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের বলেন, আমাদের প্রস্তাবনা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচন হতে হবে।
সংবিধান ৭০ অনুচ্ছেদ সংশোধন করে অর্থবিল, আস্থা ভোট ও সংবিধান সংশোধন সংক্রান্ত বিষয় ছাড়া সব বিষয়ে সংসদ সদস্যদের দলীয় সিদ্ধান্তের বাইরে ভোট দেওয়ার পক্ষে তারা মতামত দিয়েছে বলে জানিয়েছে জামায়াতে ইসলামী।
তিনটি প্রস্তাবের পাশাপাশি রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে এমপিদের দলীয় সিদ্ধান্তের পক্ষে ভোট দেওয়ার পক্ষে মত দিয়েছিল বিএনপি। এ বিষয়ে জামায়াতের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে তাহের বলেন, জরুরি পরিস্থিতি জরুরিভাবে মোকাবিলা করা হবে। তাহের বলেন, বিএনপির পক্ষ থেকে আমাদের অনানুষ্ঠানিকভাবে বলা হয়েছে তিনটি প্রস্তাবে তারা একমত। রাষ্ট্রীয় গুরুত্বপূর্ণ প্রস্তাবের বিষয়ে তারা নোট অব ডিসেন্ট দেবে।
স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়া উচিত। এ ব্যাপারে আমরা একমত আছি বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপি) যুগ্ম আহ্বায়ক সারোয়ার তুষার। তিনি বলেন, জাতীয় নির্বাচন দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হোক- এটা সবাই চায়। স্থানীয় সরকার নির্বাচনও যদি দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হয় সেটা ভালো হবে। কিন্তু টেকনিক্যাল দিকগুলো নিয়ে আমাদের আলোচনা করতে হবে। আপাতত আমরা নীতিগতভাবে এটার সাথে একমত আছি।
তিনি বলেন, কোনও কোনও দল প্রস্তাব দিচ্ছে, আমরা এটা ভেবে দেখছি যে স্থানীয় মানে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ চার মাসের জায়গায় ছয় মাস হতে পারে কিনা। স্থানীয় সরকার নির্বাচনের ব্যাপারে এখনও আলোচনা হয়নি। কিন্তু স্থানীয় সরকার নির্বাচন দলনিরপেক্ষ সরকারের অধীনে হওয়া উচিত। এ ব্যাপারে আমরা একমত আছি।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মেয়াদ নিয়ে দলের অবস্থান জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা ইতোপূর্বে বলেছি যে তিন মাস হোক আর চার মাস হোক, এটার নাম হতে হবে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার বা নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার। এটা আমরা একেবারে শুরু থেকে প্রস্তাবটা দিয়েছি। কারণ আপনারা জানেন এর আগে ২০০৭ সালে যখন এক-এগারো এসেছে তখন এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নামে কী কী হয়েছে। এ কারণে এটার নাম সুনির্দিষ্টভাবে নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকার হোক। মেয়াদ চার মাস কিংবা তিন মাস যেটাই হোক আমরা এ ব্যাপারে ফ্লেক্সিবল (নমনীয়) থাকবো। তবে যদি স্থানীয় সরকার অন্তর্ভুক্ত হয় সেক্ষেত্রে চার মাস প্রয়োজন হতে পারে।
এছাড়া সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বিদ্যমান বিধান অনুযায়ী সংসদ সদস্যদের আস্থা ভোটের পক্ষে কয়েকটি রাজনৈতিক দল ঐকমত্য পোষণ করেছে। বিএনপি ও এনসিপি বলেছে, সরকারের স্থায়িত্বের জন্য এই বিধান প্রয়োজন। তবে কোনো কোনো দল বিষয়টি নিয়ে আরও আলোচনার জন্য বলেছেন।
এদিকে বৈঠকে জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেছেন, সংস্কার কার্যক্রমে বিভিন্ন কমিশনের প্রস্তাবই চূড়ান্ত নয়। রাজনৈতিক দলগুলো যেসব মতামত দিয়েছে, সে আলোকে পরিবর্তিত প্রস্তাব নিয়েই জাতীয় সনদ (জুলাই সনদ) করা হবে। সংস্কার কার্যক্রমে রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক যুক্তি সামনাসামনি আলোচনা হলে অনেক ক্ষেত্রে অবস্থানগত পরিবর্তন হতে পারে বলে মন্তব্য করেন আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, আমাদের সময়ের স্বল্পতা রয়েছে। জাতীয় ঐকমত্য কমিশন কী কাজ করছে, তা জানতে জনমনে আকাঙ্ক্ষা তৈরি হয়েছে। সেই আকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নে আমরা দ্বিতীয় পর্যায়ের আলোচনা সরাসরি সম্প্রচারের ব্যবস্থা করেছি, যাতে মানুষ আমাদের কার্যক্রম সম্পর্কে বুঝতে পারে। যেসব প্রস্তাবে ঐকমত্য হবে না, সেগুলো জুলাই সনদে যুক্ত হবে না বলে উল্লেখ করেন আলী রীয়াজ। তিনি বলেন, সব বিষয়ে আমরা একমত হব না। কিছু জায়গায় একমত হব। বাকিটা রাজনৈতিক দলগুলো নিজেদের নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লেখ করবে। জনগণ কতটা গ্রহণ করবে, সেটা তাদের বিষয়। আগামী মাসের মধ্যে জুলাই সনদ তৈরির কাজ সম্পন্ন করার আশা প্রকাশ করেন আলী রিয়াজ। তিনি বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোকে মনে রাখতে হবে, সংস্কার সুপারিশে আমরা যেন ন্যূনতম ঐকমত্যে পৌঁছাতে পারি।
এই বৈঠকে অংশ নেয় ৩০টি রাজনৈতিক দল। এর মধ্যে ছিল লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি (এলডিপি), খেলাফত মজলিস, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, আমার বাংলাদেশ পার্টি (এবি পার্টি), নাগরিক ঐক্য, বাংলাদেশ জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (বাংলাদেশ জাসদ), জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম), বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, গণসংহতি আন্দোলন, জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জেএসডি), গণ অধিকার পরিষদ, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি, জাতীয়তাবাদী সমমনা জোট, ১২–দলীয় জোট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, গণফোরাম, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ), বাংলাদেশ লেবার পার্টি, জাকের পার্টি, জাতীয় গণফ্রন্ট, আমজনতার দল, ভাসানী অনুসারী পরিষদ/ভাসানী জনশক্তি পার্টি, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (মার্ক্সবাদী), জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ ও ইসলামী ঐক্যজোট।
জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের সহসভাপতি আলী রীয়াজের সভাপতিত্বে বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন কমিশনের সদস্য মো. আয়ুব মিয়া, সফর রাজ হোসেন, বদিউল আলম মজুমদার, এমদাদুল হক ও ইফতেখারুজ্জামান এবং প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী (ঐকমত্য) মনির হায়দার।
Facebook

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *